শিরোনাম
মীর রাকিব হাসান
প্রকাশ: ২০:১৯, ৩১ অক্টোবর ২০২৪ | আপডেট: ১৪:২৩, ১ নভেম্বর ২০২৪
মাসুদ আহমেদ উজ্জ্বল ছবি: সংগৃহীত
মেয়েদের জাতীয় দল থেকে শুরু করে বয়সভিত্তিক সব দলের গোলকিপার কোচ মাসুদ আহমেদ উজ্জ্বল। তৈরি করেছেন রূপনা চাকমাদের মতো দক্ষিণ এশীয় সেরা গোলকিপার। এই কোচের অধীনেই টানা দ্বিতীয়বার সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। আজ বিজয়যাত্রায় ছাদখোলা বাসে বসেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ঢাকা এক্সপ্রেসকে, শুনেছেন মীর রাকিব হাসান
সাফে দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন, এমন বড় সাফল্যে কেমন লাগছে?
এই আনন্দ আসলে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। একবার জিতেন, দুইবার জিতেন, দশবার জিতেন-প্রত্যেকবারই নতুনের মতো আনন্দ। আমি মনে করি সঠিক পরিচর্যা পেলে বাংলাদেশের এই নারী ফুটবলাররা আরও বড় মঞ্চে সাফল্য নিয়ে আসার ক্ষমতা রাখে। আজকে দেশের সার্বিক অবস্থা তো সবাই জানেন, তারপরও প্রচুর মানুষ রাস্তায় আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন। আজকের পরিকল্পনা বলতে এখন পর্যন্ত জানি, বাংলাদেশে ফুটবল ফেডারেশনে যাবো। সেখানে ক্রীড়া উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করবো।
অনূর্ধ্ব ২০ সাফ জয়ের পর বিতর্ক হয়েছিল, পুরো বাংলাদেশ অবাক হয়েছিল মঞ্চের বাইরে আপনাকে দেখে। বাফুফে কর্তারা মঞ্চ দখল করে রেখেছিল, যেখানে ঠাঁই পাননি আপনি…
সেটা নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ বা দু:খ এখন নেই। বাংলাদেশের মানুষ আমাকে এত ভালোবেসেছে, এই বিষয় সেখানে খুবই নগণ্য। এবারের বিজয় ও সম্মাননা সেই কাণ্ড যেন আরও ভুলিয়ে দিয়েছে। সবকিছুর উর্ধ্বে আমি এই বিজয়কে দেখতে চাই। সবাই সবার দায়িত্বের জায়গা থেকে অন্যকে যদি তার যথাযথ সম্মানটা না দেই সেখানে আসলে বলার কিছু নেই। কষ্ট আমারও লেগেছিল, চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। জীবন চলানোর জন্য অর্থ দরকার, কিন্তু সম্মানের চেয়ে অর্থ বড় না। ফুটবলকে ভালোবেসে জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। সাধ্যমতো নিজের সামর্থ্য দেশকে দিয়ে যাবো। নেতিবাচক এসব দিকের চেয়েও আমার বড় ভাবনা নিজের স্কিলের কিভাবে উন্নতি করবো, কিভাবে সেই স্কিল আমার শিষ্যদের সঙ্গে শেয়ার করবো।
আপনার শিষ্য রূপনা চাকমা এবারও সেরা গোলরক্ষক, নিশ্চয়ই গর্বিত আপনি?
অবশ্যই। দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়ে আসরের সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কারও হাতছাড়া করেনি রূপনা। টানা দ্বিতীয়বারের মতো জিতেছে মর্যাদাপূর্ণ এই ব্যক্তিগত সম্মাননা। রূপনা টুর্নামেন্টে হজম করেছে মাত্র ৪ গোল। দারুণ কিছু গোলও বাঁচিয়েছে। গতবারও প্রতিযোগিতার সেরা গোলকিপার হয়েছিল। এবারও সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। প্রতিপক্ষের আক্রমণগুলো পড়তে পেরেছে দারুণভাবে। নিজের বুদ্ধিমত্তার কারণে শট নেওয়ার জন্য প্রতিপক্ষকে জায়গাও দিয়েছে অনেক কম। মাঝে বিরতি নিয়েছিলাম জাতীয় দলের কোচ হিসাবে। নতুন করে দায়িত্বটা সামলানোর জন্য আমার হাতে সময় কম ছিল। সেটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। রূপনার মতো মনোযোগি খেলোয়ার পেলে আসলে অনেক কিছু সহজ হয়ে যায়।
রূপনা ছাড়াও অন্যান্যদের মধ্যে সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
স্বপ্না, সাথী, স্বর্ণা, জুঁইরাও পাইপলাইনে থাকা বেশ ভালো গোলরক্ষক। এদের যথাযথভাবে নার্সিং করলে আগামী ৫ বছরে বাংলাদেশের গোলকিপার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
এশিয়ার বাইরে বাংলাদেশের নারী ফুটবলের সাফল্য কিভাবে আসতে পারে?
আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ম্যাচ বাড়লে আমাদের খেলোয়াররা আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। জয়-পরাজয়ও আসবে সময়ের সঙ্গে। কিন্তু একটা সময় এর সুফল আসবে আশা করি। আমাদের দেশের নারী ফুটবলাররা বেশিরভাগ এসেছে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। সেখানে রয়েছে বাল্যবিবাহের প্রবণতা। এর মধ্যে নারীরা মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলবে যেটা সামাজিকভাবে অনেকেই মেনে নিতে পারেন না। অর্থনৈতিকভাবেও কুলিয়ে উঠতে পারেন না অনেকে। সেই জায়গা থেকে পাইপলাইন স্ট্রং করা খুব কঠিন হয়ে যায়। সম্ভাবনাময়ীদের ঝড়ে পড়তে দেওয়া যাবে না। ঘরোয়া লীগটা স্ট্রং করতে হবে। তাহলেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও বেশি সাফল্য আসবে। সবকিছুর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। এটা এমন কিছু না আজকেই গাছ লাগালাম কালকে ফল পাবো। বহুদিনের প্রচেষ্টার পরে ধারাবাহিক সাফল্য সম্ভব।
কোচ হিসাবে নারী দলের দায়িত্বে আরও কতদিন থাকতে ইচ্ছুক?
আমার সঙ্গে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নারী দলের জন্য আজকে পর্যন্তই চুক্তি ছিল। আমি খুবই আনন্দিত আজকেই আমাকে পুরুষ দলের গোলকিপার কোচ করা হয়েছে। আরও বড় পরিসরে আমি নিজেকে মেলে ধরতে পারবো। অবশ্যই নারী দলের জন্য শুভকামনা। ওখান থেকে যদি আমার স্কিল কোনো দরকার মনে করে নির্ধিদ্বায় এগিয়ে যাবো। তবে পুরুষ দলের হয়ে কাজ করতে হয়তো আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবো, সেই চ্যালেঞ্জ আমাকে আন্দোলিত করছে।
সাফজয়ী প্রধান কোচ পিটার বাটলারও তো চলে যাচ্ছেন…
আমি যতদূর শুনেছি উনি নারী ফুটবলের সঙ্গে আর থাকবেন না। উনি একেবারে চলে যাবেন এমন কিছু শুনিনি। আমি যতদূর শুনেছি উনি পুরুষ ফুটবলের সঙ্গে কাজ করবে।
দেশীয় কোচদের উন্নতি কিভাবে দেখছেন?
আমাদের দেশে বহু ভালো কোচ আছেন। দেশের ফুটবল এগিয়ে রাখার জন্য ওনারা যথেষ্ট ট্যালেন্ট। তবে দেশি-বিদেশির চেয়েও বড় কথা দলের উন্নতি। কার অধীনে দলটা বুঝে শুনে মাঠে নামতে পারছে সেটার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। একজন কোচ শুধু খেলোয়ারের ব্যক্তিগত পারফর্মেন্সই উন্নত করেন না, তাকে তার ট্যালেন্ট মতো ব্যবহারও করতে জানতে হয়। প্রতিটি খেলোয়ারকে বুঝে সেরাটা বের করতে হয়।
বাংলাদেশ নারী দলের সামনে কোন টুর্নামেন্ট আছে?
এ ব্যাপারে সঠিকভাবে জানি না। ক্যালেন্ডারটা আমার এখনো দেখা হয়নি। যতটুকু জানি সামনের বছর ফেব্রুয়ারিতে সাফের বয়সভিত্তিক খেলা আছে।
খেলোয়ার থেকে কোচ- কেমন ছিল সেই পথ?
ছোটবেলা থেকেই আমি ফুটবলের পাগল ছিলাম। বাবাও চাইতেন আমি যেন খেলাধুলায় বড় কিছু করি। ১৯৯৬ সালে বাবা মারা যাওয়ার পরে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ কমে যায়। তবে ১৯৯৮ সালে স্থানীয় কোচ খলিলুর রহমান দোলন আমাকে নতুনভাবে ফুটবলে মনোনিবেশ করতে উৎসাহিত করেন। ওনার অধীনেই নতুন উদ্যামে ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করি। ২০০০ সালে ফরাশগঞ্জ স্পোটিং ক্লাবের মাধ্যমে পেশাদায়িত্ব ফুটবল শুরু। ২০১৭-১৮ সালে ফকিরাপুল ইয়ং মেন্স থেকে খেলোয়ার জীবনের ইতি টানি। ২০২১ সালে শুরু প্রফেশনাল কোচিং ক্যারিয়ার। ২০২২ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের হয়ে কাজ করি। এর মধ্যে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের কিছুদিন দায়িত্বে ছিলাম। ফের জাতীয় দলের দায়িত্বে আজ পর্যন্ত আছি। নারী দল থেকে এবার পুরুষ দলের হয়ে কাজ করবো। সামনে মালদ্বীপ বাংলাদেশে আসছে, এই টুর্নামেন্টের মাধ্যমে দায়িত্ব শুরু। আশা করছি সামনের দিনে আরও বেশি দেশের ফুটবলে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবো।
ব্যাক্তিগতভাবে ফুটবল ফেডারেশনের কাছে কোনো চাওয়া?
আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে গোলকিপিংয়ে দেশের বাইরে ডিপ্লোমা করবো। এখানে একটা বড় অর্থ ব্যায়ের ব্যাপার আছে। কোনোভাবে সেখানে যদি ফেডারেশন থেকে সাহায্য পাই তাহলে উপকৃত হবো। আমি যেখান থেকেই দক্ষতা অর্জন করি সেটা তো দেশের ফুটবলের জন্যই ব্যায় করবো। ফুটবলারের সঙ্গে ভালো কোচ তৈরিতেও বাফুফে আরও বেশি মনোযোগি হবে সেটা আশা করি।