শিরোনাম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৩:৩৯, ১৫ নভেম্বর ২০২৪ | আপডেট: ২০:২৬, ১৭ নভেম্বর ২০২৪
গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার ১০০তম দিন পূর্ণ করেছে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য থাকলেও সমস্যা সমাধানে সরকারের সদিচ্ছায় খুশি দেশের মানুষ। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও মব জাস্টিস বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা চান তারা। ছাত্র জনতার আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা ও শহীদদের পরিবারের সদস্যদের সহায়তা বাড়াতে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান সমন্বয়কদের। এই ১০০ দিনে সরকারের কাজ, রাজনৈতিক পরিবর্তন, এবং জনগণের প্রতিক্রিয়া আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক গুরুত্ব পেয়েছে। এই অস্থায়ী সরকারের উদ্যোগে নেওয়া বেশ কিছু পদক্ষেপ যেমন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরায় শক্তিশালী করা, নির্বাচন ও প্রশাসন ব্যবস্থার সংস্কার, এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান প্রশংসিত হলেও, নানা চ্যালেঞ্জের মুখেও রয়েছে।
দাবির মুখে
প্রথম দিকে নানান চাপে ছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন সরকারের কাছে একের পর এক দাবি দাওয়া নিয়ে হাজির হতে থাকেন বিভিন্ন মহলের লোকজন। কেউ আসেন চাকরি জাতীয়করণের জন্য, কেউ গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে। এছাড়াও ঘটেছিল মব জাস্টিজের ঘটনা, শিক্ষকদের পদত্যাগ, সচিবালয়ে আনসারের অবরোধ কর্মসূচি। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ নিয়েও বেশকয়েক দিন আন্দোলন চলছিল। শেষমেশ সেটা রুখতেও সফল হন সরকার। সবই সামাল দিতে হয়েছে এই সরকারকে।
পদত্যাগের হিড়িক মোকাবিলা
সরকার পতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। আবার নিয়োগ দেওয়া হয় সেই জায়গাগুলোতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নতুন নিয়োগ হয়। কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল করা হয় প্রথম এক মাসের মধ্যেই। একইসঙ্গে সমস্যা জর্জরিত ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়।
নির্বাচনের রোডম্যাপ দেয়নি সরকার
নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে টানাপড়েন এরই মধ্য শুরু হয়ে গেছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সর্বশেষ সংলাপে নির্বাচনই প্রাধান্য পেয়েছে। তারা এই সরকারের কাছে নির্বাচন ও সংস্কারের একটি রোডম্যাপ চেয়েছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এখনো কোনো রোডম্যাপ দেয়নি। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দৃশ্যমান তাগাদা থাকলেও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন। সরকারের উচ্চ-পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা কতখানি বজায় থাকে— সেই অভিজ্ঞতা ড. ইউনুসের সরকার আগেই পরখ করতে চায়। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, ‘সংস্কারের গতিই ঠিক করে দেবে, নির্বাচন কত দ্রুত হবে।’ প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট ছাড়া অন্যান্য সব রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা প্রতিনিয়ত বৈঠক করছেন। সেখানে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা সাক্ষাৎ করেন। দলগুলোর প্রতিনিধিরা বৈঠকে রাজনীতিতে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে তাদের বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, সংস্কার এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়েও আলোচনা চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। এছাড়া সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
আইনের নানা পদক্ষেপ
সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী ও যুগোপযোগী করতে সংস্কারসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলো হলো- আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩ সংশোধনের উদ্যোগ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা, সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ কালো আইন খ্যাত আইনগুলো বাতিল, সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগে আইন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, বিদ্যমান আইন যুগোপযোগী করা, গণআন্দোলন দমনে দায়েরকৃত ফৌজদারি ও হয়ারানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, বিচার ব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশন, এটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, পাবলিক সার্ভিস ইনোভেশন ডিজিটালাইজেশনে বিভিন্ন কার্যক্রম,মডেল সাব-রেজিস্ট্রি অফিস স্থাপন, বিচার বিভাগে বিচারক নিয়োগ, সুপ্রিম কোর্টে কর্মকর্তা নিয়োগ, অধস্তন আদালতে আইন কর্মকর্তা নিয়োগ, হয়রানিমূলক ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও পরিবারের সদস্যদের সম্পদ বিবরণী, গুম বিরোধী সনদ ও কমিশন, ন্যায়পাল অফিস প্রতিষ্ঠা।
শেখ মুজিব-হাসিনা বাদ
বঙ্গভবন থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামানো হয়েছে। এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের দলীয় দিবস বলে পরিচিত আটটি জাতীয় দিবস বাদ দিয়েছে। দিবসগুলো হলো— ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস, ৫ আগস্ট শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী, ৮ আগস্ট বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেল দিবস, ৪ নভেম্বর জাতীয় সংবিধান দিবস ও ১২ ডিসেম্বর স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস। শেখ মুজিব–হাসিনার নাম বাদ দিয়ে ২০টির বেশি সরকারি হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করেছে এই সরকার। বদলে গিয়েছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর’–এর নাম। নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বা এনএসইজেড।
প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক সফর
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের এই অল্প সময়ে একটি বড় সুযোগ আসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সম্মেলন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার সুযোগ পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ ১২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান। সাইডলাইনে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, আইএমএফের প্রেসিডেন্টসহ ৪০টি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন তিনি। গতকাল তিনি ফিরেছেন জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলন কপ-২৯ থেকে। আজারবাইজানে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বনেতাদের সেঙ্গে দেখা করেছেন।
নিয়ন্ত্রণে আসেনি আইনশৃঙ্খলায়
বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম ১০০ দিনে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গত ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে পুলিশের অনুপস্থিতি এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ড জনমনে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে। ভুক্তভোগী এবং সাধারণ মানুষ সবাই বলছেন অপরাধ দমনে সরকারকে 'আরো কঠোর' হতে হবে। আতঙ্ক কাটিয়ে এখনো পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি পুলিশ। রদবদল শুরু হলেও প্রশাসনে পূর্ণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে গণপিটুনিতে প্রাণ গেছে ৪৯ জনের। মাত্র তিনটি ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সুতরাং এ বিষয়ে সরকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারেনি। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে নেয়া উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান হয়নি। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার শুল্ক করসহ নানা খাতে ছাড় দিলেও বাজার পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বিদায়ী মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ঘরে দাঁড়িয়েছে।