ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪

২০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১, ০৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিরোনাম

Scroll
সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব, স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষায় সবাই ঐক্যমত: প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে আসিফ নজরুল
Scroll
ডেঙ্গুতে সারাদেশে একদিনে ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৬২৯ জন: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
Scroll
দিল্লিকে দিয়ে দেশ শাসন করেছে আওয়ামী লীগ; ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতের গোলামী করেছে; ভারতের সাথে ধর্মীয় কারনে সম্পর্কের অবনতি হয়নি; এই আন্দোলন ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ আর থাকবে না: হাসনাত আব্দুল্লাহ
Scroll
বাংলাদেশী রোগীদের চিকিৎসা বন্ধের হুমকির তীব্র নিন্দা ভারতীয় চিকিৎসকদের বৃহত্তম সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-আএমএ’র; চিকিৎসা সেবায় বাঁধা দিলে আন্দোলনের হুশিয়ারি
Scroll
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে অংশ নিতে সুগন্ধায় পৌঁছেছে বিএনপির প্রতিনিধি দল
Scroll
এ বছর সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারতের বাসিন্দাদের মিলনমেলা হচ্ছে না
Scroll
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিনকে রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ; তিনি সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত
Scroll
তিন বছর ৭ মাস পর চট্টগ্রাম কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আকতার
Scroll
পুলিশের ওপর আক্রমণ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের ১২ অনুসারীকে ছয় দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত
Scroll
১০ দিন আগে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ; সীমান্তে আটক ভারতীয় নাগরিক
Scroll
কয়েকজন বিচারপতির বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান চলছে: সুপ্রিম কোর্ট
Scroll
ভারতের উচিত বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতা উপলব্ধি করা: মাহফুজ আলম
Scroll
১৫ বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের টেস্ট জয়
Scroll
কয়েক ঘণ্টার নাটকীয়তার পর বিক্ষোভের মূখে দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক আইন প্রত্যাহার
Scroll
গণহত্যা মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু ও কামরুল ইসলামকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে
Scroll
ভ্যাট দেয়া থেকে অব্যাহতি পেলো জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন
Scroll
সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক আজ
Scroll
যুবদল নেতা শামীম হত্যা মামলা; আওয়ামী লীগের রোকেয়া ও মোস্তফা রিমান্ডে
Scroll
দীর্ঘদিনের মিত্র ব্রুক রলিন্সকে কৃষিমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প
Scroll
পিকনিক বাস বিদ্যুৎস্পৃষ্টে তিন ছাত্রের মৃত্যু: পল্লী বিদ্যুতের ৭ জন বরখাস্ত

ভাসানীকে কে মনে রেখেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১:৫৩, ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | আপডেট: ১৫:৪৯, ২১ নভেম্বর ২০২৪

ভাসানীকে কে মনে রেখেছে

‘মজলুম জননেতা মাওলানা আবুদল হামিদ খান ভাসানীর স্বপ্নের বাংলাদেশ আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ৪৭-এ বৃটিশবিরোধী আজাদী আন্দোলন, ৪৯’র সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল গঠন, ৫২’র সালের ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন, ভারতীয় পানি আগ্রাসনবিরোধী লংমার্চ-কোথায় নেই ভাসানী? তবুও মাওলানা ভাসানী এত অবহেলিত কেন?’ ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকীকে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে।

মওলানার প্রতিষ্ঠান বিলুপ্তপ্রায়

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মওলানা ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত অনেক প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং অনেকগুলো যথাযথ পরিচর্যা ও সংরক্ষণের অভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে। রাস্তা প্রশস্ত করার অজুহাতে মওলানা ভাসানীর লাগানো পুরনো সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আবার পরিকল্পনা ছাড়াই বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য খেলার মাঠ ধ্বংস করা হয়েছে। দরবার হলসহ ভাসানীর স্মৃতিচিহ্নগুলোও জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ এবং যত্ন প্রয়োজন। এই দরবার হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক, যেখানে সব বিশ্বাস ও ধর্মের সর্বস্তরের মানুষ নির্বিঘ্নে তাদের মতামত প্রকাশ করতে সমবেত হতেন। ১৯৭০ সালের এপ্রিল থেকে আগস্টের দরবার হলটি নির্মাণ করা হয়। কাঠের স্তম্ভ, চার স্তর বিশিষ্ট টিনের ছাদ এবং তিন ফুট ইটের দেয়াল দিয়ে এটি নির্মাণ করা হয়। এখানে বসতে পারেন ৫০০ মানুষ। একটি দুই ফুট উঁচু মঞ্চ রয়েছে সেখানে। এতে দাঁড়িয়ে ভাসানী বক্তৃতা দিতেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ডাকে প্রথম সর্বদলীয় সম্মেলন হয় ১৯৭১ সালের ৯ জানুয়ারি, দরবার হলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঐতিহাসিক এই হলটি পুড়িয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টাও করে। মৃত্যুর পর মওলানা ভাসানীকে এই দরবার হলের পাশে শায়িত করা হয়। দরবার হলের ভেতরে কাঠের স্তম্ভগুলো ক্ষয় হয়ে গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে কাঠামোটিও। ১৯৮৬ সালে হলের পাশে স্থাপিত ভাসানী জাদুঘরে সংরক্ষিত ভাসানী স্মারকগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটির অবস্থাও শোচনীয়। মওলানা ভাসানী ঐতিহাসিক প্রয়োজনে মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমে কাগমারী পরগণার জমি উদ্ধার করে পাকিস্তান আমল থেকে টাঙ্গাইলে জনহিতকর কার্যক্রম শুরু করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করেন এবং দেশে-বিদেশে সাড়া ফেলে দেন।

ভাসানীর মৃত্যুর পর ১৯৮৩ সালে সরকার একটি আইন প্রণয়ন করে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে এবং তার সম্পত্তি দেখাশোনা ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য মেয়াদ নির্ধারণ করে। ভাসানীর একাধিক অনুসারীর অভিযোগ, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ট্রাস্টি বোর্ড সমঝোতা স্মারকের শর্তাবলী প্রতি অবহেলা অব্যাহত রেখেছে এবং মওলানা ভাসানী যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং নিজের জীবদ্দশায় শুরু করেছিলেন, তা বন্ধ হয়ে গেছে।মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর সমঝোতা স্মারক সই পর্যন্ত বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ট্রাস্টি বোর্ড যথাসম্ভব তাদের দেখভাল করেছে। কিন্তু সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার পর মওলানা ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত ২৫টি শিক্ষা ও অন্যান্য দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২টি ইতোমধ্যেই উধাও হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন মওলানা ভাসানীর নাতি ও ভাসানী পরিষদের সভাপতি আজাদ খান ভাসানী।

এত লম্বা রাজনৈতিক ক্যারিয়ার

মওলানা ভাসানী আনুমানিক ১৮৮৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। প্রায় ৬০ বছর তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। বেঁচেছেন প্রায় ৯১ বছর। এত লম্বা রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ভাসানী পাঠ খুব কমই হয়। এমনকি তার তৈরি করা রাজনৈতিক দলটিও নেই কোনো আলোচনায়। এরও ইতিহাস আছে। ভাসানী যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনি পাশে কোনো সুযোগ্য সহযোদ্ধা পাননি যারা দলটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এমনকি তার মৃত্যুর পর জিয়াউর রহমানের বিএনপিতে একটা বড় অংশ গিয়ে ভীড়ে যায়। ভাসানীর সমতার ভিত্তিতে সমাজ গঠনের যে স্বপ্ন তা মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। উপমহাদেশের কিংবদন্তি রাজনৈতিক নেতা ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। টাঙ্গাইলের সন্তোষে তার স্বপ্ন, কাজ ও স্মৃতিচিহ্ন বিগত সরকারগুলোর 'হীনমন্যতার' কারণে রয়ে গেছে অবহেলিত।

আজ মৃত্যুবার্ষিকী

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ রোববার (১৭ নভেম্বর)। ১৯৭৬ সালের এই দিনে ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। টাঙ্গাইলের সন্তোষে মাওলানা ভাসানীকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়। এ উপলক্ষে ঢাকা ও টাঙ্গাইলের সন্তোষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বাণী দিয়েছেন। 

ভাসানীকে জানতে হলে…

বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাসানীকে নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। ফলে আমরা অনেকেই ভাসানী সম্পর্কে খুব একটা জ্ঞান রাখি না। তার সম্পর্কে বিচ্ছিন্ন কিছু তথ্য সকলের জানা রয়েছে। তবে বৃহৎ অর্থে ভাসানী চর্চাই হয় না আমাদের ইতিহাসে। ভাসানীর উপর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। তার রচিত ‘মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’, ‘কাগমারী সম্মেলন’ ও ‘ভাসানীর ভারত প্রবাস: পাকিস্তানি শাসকচক্রের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র’ বইগুলো থেকে বিশেষভাবে চেনা যায় ভাসানীকে। এছাড়া আরও বেশ কিছু বই রয়েছে।

ভাসানীর স্বাধীকার আন্দোলনই এনে দেয় স্বাধীনতা

বাঙালি জাতির স্বাধীকার আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। প্রতিটি পর্যায়ে কোনো না কোনো নেতার ভূমিকা রয়েছে। প্রথম পর্যায় থেকে চূড়ান্ত পর্যায় যদি ইতিহাসে তাকাই তবে দেখা যাবে, ভাসানী ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আগে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বলেছিলেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যেভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে, তাতে এমন দিন আসবে, যখন পূর্ব বাংলাবাসী পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানাবে।’

আওয়ামী লীগ থেকে কেন বের হলেন ভাসানী?

১৯৫৭ সালের ২৪ জুন ভাসানীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের স্থায়ী বিচ্ছেদ ঘটে। এখন কেন ঘটে এটা বোঝার জন্য একটু পেছনে যেতে হবে। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে পূর্ববঙ্গের রাজনীতির বড় চরিত্র ছিলেন তিন জন। এরা হলেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। রাজনৈতিক যে কোনো সিদ্ধান্ত এ অঞ্চলের জনগণ তাদের মতামতের ওপরই নির্ভর করতেন। কিন্তু তিনজনেরই মতপার্থক্য ছিল। এদের মধ্যে ভাসানী খুব সোজাসাপ্টা খোলামেলা কথা বলার কারণে বাকিরা বিশেষ করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী খুব অস্বস্তিতে পড়তেন। তবে এটা বলতেই হবে যে,  রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও মতপার্থক্য থাকলেও তিনজনে একে-অপরকে শ্রদ্ধা, সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেছেন।

ভাসানীর নির্বাসন ও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে

৫৪'র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২২৩ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। এই বিশাল বিজয়ে মুসলীম লীগের দুর্গ ধসে পড়ে। পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের রাজনীতি যে আর কার্যকর নয় সেটাও প্রমাণ হয়ে যায়। তখন পাকিস্তানে গোলাম মোহাম্মদ আর মোহাম্মদ আলীর ক্ষমতার লড়াই চলছে। সোহরাওয়ার্দী মোহাম্মদ আলীর মস্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী হয়ে গেলেন। এখান থেকেই শুরু হয় সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর মূল দ্বন্দ্ব। ভাসানী তখন ব্রিটেন ছিলেন। ব্রিটেন থেকে আসেন কলকাতায়। প্রায় পৌনে চার মাস তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসন বেছে নেন। যেহেতু পাকিস্তান সরকার তাকে গুলি করার হুমকি দিয়ে রেখেছে। কলকাতায় ভাসানীর অবস্থান নিয়ে পূর্ণ একটি গ্রন্থও রচিত হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ভাসানীর দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে। ভাসানী বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে ব্যাপকভাবে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আসছিলেন। এক হলো, পাকিস্তানে ভাসানী সংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব দাবি করছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি চাইছিলেন পররাষ্ট্র নীতি হবে বন্ধুত্বপূর্ণ তবে যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা হবে না। অর্থাৎ কোনো সামরিক জোটে পাকিস্তান যেন যুক্ত না হয়। এসব বিষয় নিয়ে কলকাতা বিমান বন্দরে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ভাসানির তর্ক-বিতর্ক হয় সাংবাদিকদের সামনে। 

ভাসানীর দেশে ফেরা ও সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রী হওয়া

দেশে ফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে ভাসানী ফিরে আসেন ২৫ এপ্রিল, ১৯৫৫। ঢাকায় ফিরেই তিনি সোহরাওয়ার্দীকে চাপ দিতে থাকেন যেন সকল বামপন্থি ও কমিউনিস্টকর্মী ও নেতাদের মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। এমনকি সকল রাজনৈতিক কর্মীর হুলিয়া বাতিলেরও দাবি করেন তিনি। ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। ১৯৫৬ সালে চৌধুরী মোহাম্মদ আলির পদত্যাগের পর সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। সোহরাওয়ার্দী ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর ১২ থেকে ১৯৫৭ সালের অক্টোবর ১১ তারিখ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই মওলানা ভাসানী সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেন।

১৯৫৭ সালের ১৪ জুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পল্টন ময়দানে বক্তৃতায় সোহরাওয়ার্দী শাসনতন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন আদায় হয় বলে দাবি করেন। তাৎক্ষণিকভাবে তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। ভাসানী আক্ষরিক অর্থে সোহরাওয়ার্দীকে প্রায়ই অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিতেন। কখনও কখনও অপমানও করে বসতেন। যেমন, প্রধানমন্ত্রী হয়েই সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় আসেন এবং ওই দিনই পল্টন ময়দানে তিনি ভাষণ দেন। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল। তাই ওই জনসভায় ভাসানী ব্যক্তি আক্রমণ করে বসেন। তিনি বলেন, ‘যদি প্রধানমন্ত্রী খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হন তবে তাকে জনতার সামনেই বেত্রাঘাত করা হবে।’ পরে আবার বলেন, ‘দুই সপ্তাহের মধ্যে যদি নয়টি জেলায় নয় হাজার মণ খাদ্য না পাঠাতে পারো তবে তোমার ওই প্রধানমন্ত্রীর গদিতে আমি পদাঘাত করি।’

কাগমারী সম্মেলন ও ভাসানীর আসসালামু আলাইকুম

সাম্রাজ্যবিরোধী আন্দোলনে জনমানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেই ১৯৫৭ সালের ৯-১০ ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইল জেলার কাগমারীতে দুই দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এটাকেই বলা হয় কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন। একই সময়ে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনও হয় ৭-৮ ফেব্রুয়ারি। কাগমারী সম্মেলনকে ভাসানী আন্তর্জাতিক রূপ দিতে চেয়েছিলেন। ভারত থেকে অনেকেই এই সম্মেলনে অংশ নেন। এমনকি ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই সম্মেলনে অংশ নেন। তাকে ভাসানী গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলেন, পূর্ব বাংলা একদিন স্বাধীন হবেই। ১২ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। রাজনীতিকে রাজধানীকেন্দ্রিক না করে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াও উদ্দেশ্য ছিল এই সম্মেলনের। ভাসানী ৪৭'র আগে মুসলীম লীগকে সমর্থন করেছিলেন লাহোর প্রস্তাবে বিশ্বাস করে। কিন্তু ক্রমেই সেই বিশ্বাসে চীড় ধরে। আর তাই তিনি সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। বের হয়ে তিনি লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থার দাবি করতে থাকেন। তিনি এই কাগমারী সম্মেলনে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন।

৭ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। ভাসানী হলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি। আর আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা হোসেন সোহরাওয়ার্দী তখন প্রধানমন্ত্রী। তিনিও উপস্থিত। সেখানে ভাসানী তার বক্তব্য তুলে ধরেন। যার এক পর্যায়ে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যেভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে, তাতে এমন দিন আসবে, যখন পূর্ববাংলাবাসী পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানাবে। তার এই বক্তব্যে সোহরাওয়ার্দী খুব বিব্রত হন। উত্তরে তিনি বলেন, ‘…Separatism কোনো সমাধান নয়। আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। পাকিস্তানের সংহতি সবকিছুর ঊর্ধ্বে।’ ভাসানীর উত্থাপিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রসঙ্গে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেন,‘…আমার মনে হয় শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন আমরা পাইয়াছি। কিন্তু এমন কতকগুলি ব্যাপার যেমন বৈদেশিক সাহায্য, কেন্দ্রীয় অর্থ বণ্টন বিষয়ে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রহিয়াছে…’

কাগমারী সম্মেলনের পর থেকে আওয়ামী লীগে দুই গ্রুপের সৃষ্টি হয়। একটি সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ আরেকটি ভাসানী গ্রুপ। ভাসানীর সঙ্গে বেশিরভাগই রয়েছে বামপন্থী ও কমিউনিস্টপন্থী কর্মীরা। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা। একই সঙ্গে তিনি কমিউনিস্টদের পছন্দ করতেন না।

চূড়ান্ত বিদায়

১৩-১৪ জুন আওয়ামী লীগের নির্বাহী পরিষদের অধিবেশন বসে ঢাকার শাবিস্তান প্রেক্ষাগৃহে। ভাসানী এই সভায় যোগ দিতে চাননি। কিন্তু অনেকের অনুরোধে আসেন। কিন্তু সেখানে পরিস্থিতি ছিল খুব অস্বস্তিকর। প্রতিনিধিরা ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিলেন ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী সমর্থকে। অনেকে ভাসানীকে নিয়ে 'ভারতের দালাল মুর্দাবাদ' বলে অশালীন শ্লোগানও দিতে থাকে। সেখান থেকে ভাসানী দ্রুত চলে আসেন। সেই অধিবেশনে সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্র নীতি সকলের সমর্থন পেয়ে যায়। যদিও ১৬ জুন ভাসানী ১৩-১৪ তারিখে কাউন্সিল অধিবেশনে অনুমোদন পাওয়া পররাষ্ট্র নীতির তীব্র সমালোচনা করে বিবৃতি দেন। এসব কিছুর মধ্যে আসলে আওয়ামী লীগে ভাসানীর থাকার মতো আর কোনো পরিস্থিতিই রইলো না। অবশেষে ২৪ জুলাই ভাসানী তার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কে সমাপ্তি ঘটান।

আওয়ামী লীগও হারায় তাদের প্রথম সভাপতি, এক সাহসী, দেশপ্রেমী ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদকে। আওয়ামী লীগের গঠন, কর্মী সমন্বয়, প্রগতিশীল করার জন্য মুসলীম শব্দ বাদ দেওয়া- সব কিছুর নেপথ্যে ছিলেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু নীতি আদর্শে তিনি আপস না করায় বের হয়ে নতুন দল করেন। ভাসানী জেদি রাজনৈতিক চরিত্র ছিলেন। যার প্রমাণ স্বরুপ দেখা যায়, মত দ্বৈততার জন্য ৭০-এর নির্বাচনেও তিনি অংশ নেননি।

আরও পড়ুন