শিরোনাম
মীর রাকিব হাসান
প্রকাশ: ১২:২৮, ২৭ নভেম্বর ২০২৪ | আপডেট: ১১:৩৭, ২৮ নভেম্বর ২০২৪
জাকিয়া রায়হানা রুপা। ছবি: মোমেন্টওয়ালা
বই পড়ার সময়ও যেন এখন আর অনেকের নেই। একটা বই পড়ার চেয়ে একটা রিল, ইউটিউব ভিডিও কিংবা একটা মুভি দেখতেই যেন সবাই আগ্রহী। আপনার পড়া যদি শুধু সোশ্যাল মিডিয়া স্ট্যাটাস, ১০টা পয়েন্টে বইয়ের সারসংক্ষেপ, কিংবা ব্লগ স্ক্যান করে যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে বলতেই হচ্ছে, আপনি অনেক কিছুই মিস করছেন। আপনার জানা বোঝা, মস্তিস্কের বেড়ে উঠার জন্য পৃথিবীতে নানা মানুষ নানা রকমভাবে বই পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এখন চলছে আমাজন কিন্ডল, অ্যাপল বুকস, গুডরিডস, সেইবই, প্রতিলিপি—এসব অ্যাপে বই পড়ার যুগে। তবে এসবের ভীড় থেকে বের হয়ে জাকিয়া রায়হানা রুপা নিলেন নতুন এক উদ্যোগ। কি সেই উদ্যোগ?
লেকের ধারে বইয়ের বাসা
গাছপালায় পাখির বাসা এক পরিচিত দৃশ্য। রাজধানীর ধানমন্ডি লেকের পাশে দেখা মিলছে ব্যতিক্রম এক দৃশ্যের! লেকের পাশে বিভিন্ন গাছে ঝুলে আছে বই রাখার ছোট ছোট বাক্স, দেখতে পোষা পাখির ঘরের মতোই। লেকে আসা দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করেছে এসব বইয়ের বাক্স। রুপার এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছে অনেকেই। ইচ্ছে হলেই আপনি সেখান থেকে বই নিয়ে পড়তে পারবেন, এর জন্য কোনো মূল্যও দিতে হবে না। এই বুককেস, বা বইয়ের বাক্সকে মাইক্রো লাইব্রেরি কিংবা উন্মুক্ত পাঠাগারও বলেন অনেকে।
কীভাবে আসলো ভাবনা
পৃথিবীর উন্নত অনেক দেশেই এমন ভাবনা প্রচলিত। রাস্তা, বনে জঙ্গলে, নদীর ধারে এমনকি অনেকের বাড়ির সামনেও মাইক্রো বুক কেস, বুক শেলফ আছে। ওখানে ওই বুকশেলফ থাকে ওপেন, তালা দেওয়া না। নিরাপত্তা রক্ষীও নেই যে ওগুলো পাহাড়া দেবে। ওখান থেকে নিয়ে পাঠকরা বই পড়ে, পড়া হয়ে গেলে আবার রেখে দেয়। অনেকেই আবার বই ডোনেট করে। সে ধারণার প্রয়োগ বাংলাদেশে আজ্যবধি দেখা গিয়েছে বলে তেমন কেউ বলতে পারেননি। বই পড়ুয়া রুপার মাথায় এমনটা আসলো জার্মানে বসবাসরত বাংলাদেশি মানো বিশ্বাসের এক ফেসবুক স্ট্যাটাসের জের ধরে। জার্মানির এমন দৃশ্যের মনোজ্ঞ বর্ণনা নিজের ফেসবুক পেজে লিখেছিলেন বাংলাদেশি যুবক মানো। সেই দৃশ্যে মুগ্ধ হয় রুপা, নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পাতায় ভাগ করে নেন। দুদিন বাদে মনে হলো, আমিও কেনো করছি না। ভাবলেন, বাড়ির কাছেই ধানমন্ডি লেক। সেখানে ছোট ছোট বুককেস স্থাপন করলে কেমন হয়? সকালে বা বিকেলে লেকের ধারে হাঁটতে আসা মানুষ বই পড়তে পারবেন। রুপার সবচেয়ে প্রিয় লেখক মহিউদ্দীন মোহাম্মদ। লেখকের শক্তিশালী গদ্য ও পরিষ্কারভাবে চিন্তা প্রকাশের ক্ষমতা রুপাকে আন্দোলিত করে। রুপা বলেন,‘ওনার বই পড়া শুরুর থেকেই আমার মনের মধ্যে খুব ইচ্ছে জাগলো এই বইগুলো যদি সবাইকে পড়াতে পারতাম, যদি পুরো বাংলাদেশের মানুষ এই বইগুলো পড়তো তাহলে অনেক কিছু জানতে পারতো শিখতে পারতো, বুঝতে পারতো, ম্যাচিউরড হতে পারতো, ইচ্ছাটা বেশ আগে থেকেই। কিন্তু তখন আমি কোনো রাস্তা খুজে পাইনি যে এই ইচ্ছা পূরণের। ফেসবুক স্ট্যাটাসটি সেই দ্বার খুলে দিলো।’
যেই ভাবনা সেই কাজ
এই ভাবনায় শুরুতেই রুপাকে সঙ্গ দিলেন বন্ধু রাশেদুল ইসলাম রানা। প্রথম বুককেসটা ১৬ নভেম্বর ধানমন্ডি ৭ নম্বর রোডের লেকের মসজিদের পেছনের রাস্তায় বসানো হলো। প্রথমটির ডিজাইন ইন্টারনেট থেকে নিলেও পরেরগুলোর নকশা করেন রুপা। প্রথম বুককেসটি তৈরি করেছে সিমবায়োসিস আইটি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সেই বুককেসে ছিল রুপার প্রিয় লেখক মহিউদ্দিন মোহাম্মদের ৫টি বই। পরে হুমায়ুন আজাদ, আহমদ ছফা, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বার্ট্রান্ড রাসেলসহ বিভিন্ন লেখকের বই বুককেসে রাখা হয়। রুপা বলেন,‘আমি প্রতিদিন লেকে যাই, লেকের পুরো পরিবেশটা আমার চেনা। কোথায় কোথায় মানুষ বসে আড্ডা দেয়, প্রতিটা পয়েন্ট আমার জানা। যখন আমি কাজটা শুরু করেছি, মনে হয়েছে আমি আমার বাড়ির পাশের লেক দিয়েই শুরু করি।’
আছে কি কোনো প্রতিবন্ধকতা
উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবন্ধকতা আসেনি। বরঞ্চ অনেকেই অনেক উৎসাহ দিচ্ছে। তবে মেনে নিলেন মাঝখানে ছোট্ট একটা ভুল করে ফেলেছিলেন। রুপা বলেন,‘সবকিছু একা সামলাচ্ছি তো, তাই হয়তো এই ভুলটা। একা বলতে ফিজিক্যালি গিয়ে বক্স বসানো, মিস্ত্রিকে অর্ডার দেওয়া, পরিকল্পনা করা যে আমি কি বই কিনবো, সব কিছুই তো ব্যাক্তিগতভাবে আমার চিন্তা থেকে করা। অনেকেই টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। বই পাঠিয়েছেন। কিন্তু এত কাজের ভিড়ে একটা জিনিস খেয়াল করিনি।’ কি সেই ভুল? ‘আমি দ্বিতীয়বার যেদিন একটা বুক কেস নিয়ে সেট করলাম। একটা কারেন্টের পিলারে সেট করলাম, আরেকটি গাছে সেট করেছি। সেদিন অসুস্থও ছিলাম। সবকিছু মিলিয়ে আমি খেয়াল করিনি। ওগুলো তারকাটা ব্যবহার করা হয়েছে। ওটা একদমই ভুল হয়েছে আমার। পরদিনই এই ভুল নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষমা চেয়েছি। পরবর্তীতে আমি যখন যেখানে মাইক্রো বুক কেস বসাবো, কখনোই গাছে তারকাটা ব্যবহার করবো না।’
অনুমতির ব্যাপার স্যাপার
কোথাও থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। সরকারি গাছ, যদি আসে আইনী খড়গ? রুপা বলেন,‘আসলে জিনিসটা খুব ছোট পরিসরে হচ্ছে। যে কারণে যে কোনো জায়গায় ঝুলিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। যেহেতু এটা বই রিলেটেড ব্যাপাার। আমার মনে হয় না বিষয়টি নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ থাকবে। আমি যদি বড় আকারে ইট সিমেন্ট দিয়ে লেকে কিছু করতে যেতাম, সেক্ষেত্রে হয়তো দরকার ছিল। লেকে চারটি পয়েন্টে বসিয়েছি। কেউ এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ করেনি। আমিতো প্রতিদিন একবার করে লেকে গিয়ে বইগুলো দেখে আসি। এগুলোকে এখন আমার সন্তানের মতো মনে হয়। অনেক মানুষের সঙ্গেই কথা হয়, সবাই অনেক সাধুবাদ জানাচ্ছে।’
খরচ-খরচাদি
প্রথম বুককেসটা বসিয়েছেন সম্পূর্ণ নিচ খরচে। কিন্তু তারপর থেকে যে বুককেসগুলো বসানো হচ্ছে তার জন্য একটা পোস্ট দিয়েছিলেন সহযোগিতা চেয়ে, ‘কেউ যদি আর্থিক সহযোগিতা করতে চায় আমাকে জানাবেন।’ তারপর অনেক মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। ‘ঠিক কতজন এগিয়ে এসেছেন আমার মনে নেই। তবে প্রত্যেকটা মানুষকে মেনশন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছি। মোট টাকা উঠেছে ২৭ হাজার। সেই টাকা দিয়ে নয়টি বুক কেস হয়েছে এবং বই হয়েছে। নয়টার মধ্য থেকে প্রথমে তিনটি বুককেস বইসহ সেট করেছি। আজ বাকি ছয়টি বুক কেস বিভিন্ন জায়গায় সেট করেছি।’ বলেন রুপা।
ঝড় বৃষ্টি মাথায় রেখে
ঝড় বৃষ্টির কথা তো প্রথম থেকেই মাথায় ছিল। মিস্ত্রিকে দুটি পয়েন্ট দিয়েছিলেন- যত কম খরচে করা যায় ও বই কোনোভাবেই বৃষ্টিতে ভেজা যাবে না। রুপা জানান,‘এখন যে চারটা বসানো আছে এগুলো কেরোসিন কাঠের। আরও কিছু বিষয় আছে যার জন্য বৃষ্টিতে বইগুলোর কোনো ক্ষতি হবে না। পরেরগুলো পিবিসির যে প্লাস্টিক বোর্ড আছে সেগুলো দিয়ে বানাচ্ছি। এটা আরও বেশি সেফ।’
সংখ্যায় বুককেস-বই
এখন মাইক্রো বুককেস আছে চারটি। এই চারটি বুককেসে ৩০-৩৫ টি বই আছে। আগামীতে আরও ছয়টি বুককেস বসানো হবে। এই বুককেসে ৬-৭টি বই থাকবে। এই নাম্বারের বুক কেস শেষ হলে আবার নতুন উদ্যোগ।
পাঠক কে
তরুণ তরুণীদেরই ভিড় বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে সকালের দিকে বেশি পাঠক আসে। রুপা বলেন,‘সকালে অনেক বাচ্চার মায়েদের পড়তে দেখেছি। বাচ্চার মায়েরা স্কুলে বাচ্চা দিয়ে ওখানে বসে বই পড়ে। এমনকি অনেক সময় দেখেছি বাচ্চাকে পাশে বসিয়ে বই পড়ে শুনাচ্ছেন। এই ধরণের মানুষকেই বেশি বই পড়তে দেখলাম। লিপিবদ্ধ করা হয়নি যে প্রতিদিন কতজন মানুষ আসে। আমি প্রতিদিন একবার যাই। পুরোটা রাউন্ড দেই। আমি দেখি কি ধরণের মানুষ বই পড়ছে বই নাড়াচাড়া করছে।’
লেকে বসেই পড়তে হবে
লেকে বসেই পড়তে হবে। বই বাড়িতে নেওয়া যাবে না। এটা করার একটা কারণ আছে। অনেক সময় সদিচ্ছায় নিয়ে গেলেও পরে হয়তো আলসেমি করে দেওয়া সম্ভব হবে না। এমনভাবে অনেক বই হয়তো আটকে থাকবে। তাই আপাতত বাক্সের আশেপাশেই বই নিয়ে পড়তে হবে। ২৪ ঘন্টাই বই পড়তে পারবেন। যার যখন ইচ্ছে হবে ওখানে বসে বই পড়তে পারবে। এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে কে কখন পড়তে চায়।
স্থান পাবে কোন ধারার বই
সেসব বই পড়লে মানুষ কিছু শিখতে পারবে, জানতে পারবে। সেই বইগুলোকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। রুপা বলেন,‘আমাদের রাষ্ট্রের যে সমাজ ব্যবস্থা সেসব বিষয়ে খুঁটিনাটি অনেক কিছু জানা প্রয়োজন। সমস্যা, সমাধানের রাস্তা নিয়ে বইগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছি। পরবর্তীতে এই শেখা থেকে সে যেন সমাজকে কিছু একটা দিতে পারে সেই ধরণের বই দিচ্ছি।’
সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ুক
রুপার স্বপ্ন সারাদেশে এই ভাবনা ছড়িয়ে পড়ুক। ‘আমি যেমন কাজে দেখিয়ে দিয়েছি সেটা যেন আরও অনেকে করে। কথা কম বলে কাজ বেশি করতে হবে। শুধু ভেবে আলোচনা করে লাভ নেই। আমি বললাম মানুষ উদ্বুদ্ধ হলো, তারপর ছেড়ে দিলো তাতেই হবে না। যে যার এলাকায় করতে পারে। এটা ভালো কাজ, মানুষ করতে পারে। পুরো বাংলাদেশেই এটা করতে পারে। সরকারও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে। সরকার এটা আরও বড় আকারে করতে পারে। সব ধরনের স্টেশনেও দিতে পারে।’ এমনটাই মনে করেন রুপা।
রুপা আদতে কী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলা বিষয়ে লেখাপড়া শেষ করা রুপা স্বামী, দুই মেয়েসহ থাকেন ধানমন্ডি এলাকাতেই। রুপা একজন গৃহীনি, মা। বাচ্চা- সংসার নিয়েই তুমুল ব্যস্ততা। সেসব পেড়িয়ে আরও আছে, কী? ‘আমার অনেক গাছ রয়েছে, আমার তিনটি কুকুর, একটা বিড়াল আছে। এর বাইরে আমি আরও তিনটি কাজ করি- মেন্টাল হেলথ, সেক্স এডুকেশন, প্যারেন্টিং বিষয়ে ভাবনা শেয়ার। পাঁচ ছয় বছর ধরে এই বিষয়গুলো পড়ে পড়ে শিক্ষামূলক পোস্ট ফেসবুকে দেই। প্রতিদিন অনেক ধরণের সমস্যার সমাধান চেয়ে নক আসে, সেগুলো নিয়ে আমার কথা বলতে হয়। আমি প্রযোজনে এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের কাছে রেফার করি। এসব নানা কাজেই আমার ব্যস্ততাতেই কাটে।’ বলেন রুপা। রাস্তার প্রাণীদের অধিকার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার কাজও করেন তিনি।
রুপা যেখানে অনন্য
মানব শরীরের পুরোটা অথবা বিভিন্ন অংশ দান করা যায়। যে রোগীদের শরীরের বিভিন্ন অংশ নষ্ট হয়ে যায়, তারা দান করা এসব প্রত্যঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে পুনরায় সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। এমন মহান কাজেই মানবিক রুপা এগিয়ে এসেছেন। ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে রুপা মরণোত্তর চোখ ও দেহ দান করেছেন। রুপা বলেন,‘মানুষের জন্য কিছু করতে পেরে আমি সুখী হই। নেওয়ার চেয়ে দিতে আমি বেশি সুখী হই। যখন যেটুকু পারি করতে চেষ্টা করি। এভাবেই এই ভাবনাটা আসে। অর্থনৈতিকভাবে আমার কোনো ধরণের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, গোল্ড নেই, তাই সে বিষয়ে খুব বেশি কিছু হয়তো করতে পারবো না। তবে দেহটা তো আমার নিজের, দান করেছি। প্রায় তিন বছর হলো এটা করেছি।’ এ গুণ তিনি পেয়েছেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে। তাঁর মা ছিলেন একজন সমাজসেবক।