শিরোনাম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৩:৩৫, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | আপডেট: ১৯:০৩, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
‘আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যৎ, এখনই’-প্রতিপাদ্য করে আজ দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে ১০ ডিসেম্বরকে ‘মানবাধিকার দিবস’ ঘোষণা করে। সেই থেকে প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক ‘মানবাধিকার দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে। এ ঘোষণার মাধ্যমে স্বীকৃত হয় যে জন্মস্থান, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস, অর্থনৈতিক অবস্থা কিংবা শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্বিশেষে মানবাধিকার সর্বজনীন ও সবার জন্য সমান। প্রতিটি মানুষ জন্মগতভাবেই এসব অধিকার লাভ করে। প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকার ও রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বের বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ঘোষণাপত্র গ্রহণের দিনটি প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জুলাই-আগস্ট বিপ্লব সংঘটিত হয়। তারপরও শেষ হয়ে যায়নি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নারী শিশু নির্যাতন, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘মব হত্যাকাণ্ড’।
গণপিটুনিতে নিহত
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশকেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সাড়ে ছয় বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ২৮৬ জন। এমনকি ২০২৪ সালে নির্বাচনের পর থেকে জুলাই পর্যন্ত গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল ৩২ জন। শুধু ঢাকাতেই নিহত হয় ১৬ জন। মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘গত ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে মানবাধিকার গুরুত্ব পায়নি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ছিল। গুম হত্যাও চলেছে। তিনি বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে আমরা গুম নিয়ে একটি কমিশন করার কথা বলছিলাম, তখন আমাদের দাবিগুলোকে উপেক্ষা করা হয়। আমাদের ধারণা ছিল ৬০০ থেকে ৭০০ জন গুমের শিকার হয়। কিন্তু ৫ আগস্টের পর ১ হাজার ৬০০ জনের গুমের তথ্য প্রকাশ পায়। যারা ফিরে এসেছেন তারা কেউ কেউ মুখ খুলেছেন।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে
২০০৪ সালের পর থেকে ২০ বছরে ৩ থেকে ৪ হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ৫ আগস্টের পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়নি। যদিও তা কমে হাতে গোনা অবস্থায় এসেছে। সরকার পতনের পর ‘মব জাস্টিসের’ শিকার হয় স্বৈরাচারী সরকারের সহযোগী ও সমর্থকদের অনেকে। কিন্তু একটি মব হত্যাও মেনে নেওয়া যায় না। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বিগত দিনের চেয়ে কমে এলেও বন্ধ হয়নি। রাষ্ট্রীয় হেফাজতে হত্যা কোনোভাবেই কাম্য নয় কিন্তু তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। এখনো সরকারের মধ্যে এক ধরনের শিথিলতা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। মানুষের মধ্যে এখনো অস্থিরতা কাজ করছে। সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করলে তাদের জবাবদিহি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মানসিকতা থাকলেই মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হবে ।
নারী হত্যা-হয়রানি
পুলিশের জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্যমতে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ফোনকলের ভিত্তিতে ৯ হাজার ৭১৪টি স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে নির্যাতনের ঘটনার তথ্য পাওয়া যায়। এ সময় ৮৩৯টি নারী হত্যা-সম্পর্কিত কল আসে। গত ১০ মাসে ৯৯৯-এ ১ হাজার ৭৯টি নারী নির্যাতনের সেবা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম মনে করেন নারী অধিকার কমিশন গঠন করা হলেও সরকার নারীর অধিকার বিষয়ে খুব স্পষ্ট ও জোরালো অবস্থান নেয়নি। নারী হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনাগুলো সমাজে বিদ্যমান আছে। ‘বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র গঠনে নারী-পুরুষের সমতা সৃষ্টি গুরুত্বপূর্ণ’—উল্লেখ করে সভাপতি বলেন, নারীর শিক্ষা ও কর্মের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি, সম্পত্তিতে অধিকার ও কোটা ব্যবস্থাসহ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। জাতীয় মানবাধিকার সচিব কমিশনের সেবাস্টিন রেমা বলেন, নারীর অধিকার রক্ষায় কমিশনে আলাদা একটি কমিটি আছে। স্বামী -স্ত্রীর বিবাদ মীমাংসার জন্য কাজ করছে আরও একটি টিম। মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে কমিশন সরকারের সংশ্লিষ্ট উইংগুলোকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সুপারিশ করে। তিনি মনে করেন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কঠোর আইন ও আইনের শাসন প্রয়োজন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার বাণী
রাষ্ট্রপতির বাণী
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তিনি বলেছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মানবাধিকার দিবস উদযাপনের উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই।
তিনি বলেন, মানুষের সর্বজনীন, সহজাত, অহস্তান্তরযোগ্য ও অলঙ্ঘনীয় অধিকারই হলো মানবাধিকার। মানবাধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার ও চাহিদা নিশ্চিতের পাশাপাশি, সবার নিরাপত্তা বিধান এবং স্বাধীনতা ও মর্যাদা সমুন্নত রাখে। ১৯৪৮ সালের এই দিনে মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘ কর্তৃক মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানেও মৌলিক মানবাধিকার, স্বাধীনতা, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগেও ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় প্রতিনিয়ত আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হচ্ছে। দেশে মানবাধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি জনসাধারণের সম্পৃক্ততা ও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তৃণমূল পর্যায়ে কমিশনের কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। সমাজে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি, সহমর্মিতা, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি করতে হবে। বিশ্বের সব নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অধিকার রক্ষায় সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।
বাণীতে আরও তিনি বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে একটি গণমুখী ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে নিয়মিত গণশুনানি আয়োজন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও প্রতিবেদন দাখিল, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানবাধিকার বিষয়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ প্রেরণ, মানবাধিকার বিষয়ে গণসচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে বিভিন্ন জেলা কমিটির সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন, শিশু ও নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা বন্ধে কার্যক্রম গ্রহণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে হবে। মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের প্রতিকার পাওয়ার পথ সুগম করতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিরপেক্ষভাবে কার্যকর অবদান রাখবে-এটিই সবার প্রত্যাশা।
প্রধান উপদেষ্টার বাণী
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাণীতে তিনি বলেন, মানবাধিকার সর্বজনীন ও সবার জন্য সমান যা জন্মস্থান, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস, অর্থনৈতিক অবস্থা কিংবা শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্বিশেষে সবাই সমভাবে পাওয়ার অধিকার রাখে এবং আমাদের সরকার সর্বাবস্থায় সকল ধর্ম-বর্ণ ও ধনী-দরিদ্র মানুষের মানবাধিকারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।