শিরোনাম
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩:৩৬, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | আপডেট: ১৮:৫৮, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ, ইরান-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলা, গাজা যুদ্ধ, লেবাননে ইসরায়লের অতর্কিত হামলা ও অভিযান ছিল অন্যতম। কাজেই স্বস্তির আশা নিয়ে শুরু হলেও বছরের শেষ প্রান্তে এসে বিশ্বজুড়ে বেড়েছে অস্থিরতা। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ-উত্তেজনা কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কোনোটারই সমাধান হয়নি। এর সঙ্গে বরং যোগ হয়েছে ইরান-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলা। অস্থিরতা বেড়েছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে।
নির্বাচন ঘিরে অস্থিরতা
বিদায়ী ২০২৪ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানা ঘটনাপ্রবাহে বিক্ষত। রয়টার্স লিখেছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বকারী ৬০টির বেশি দেশে এ বছর ভোট হয়েছে। অনেক দেশে তৈরি হয়েছে সহিংসতা ও বড় রকমের ভীতির পরিবেশ। নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়ে দুটি হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে ফিরেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরপর গত নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তুমুল প্রতিযোগিতা আর অস্থিরতার ভয় নিয়েও তিনি হোয়াইট হাউসের টিকেট নিশ্চিত করেছেন তিনি। বিদায়ী বছরে মেক্সিকোর নির্বাচনে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে, তা বিগত সকল নির্বাচনী সহিংসতাকে ছাড়িয়েছে। শুধুমাত্র নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন সময় সেখানে ৩৭জন প্রার্থী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সবকিছু ছাপিয়ে নির্বাচনে দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ক্লডিয়া শেইনবাউম। চারটি মহাদেশের বিভিন্ন দেশে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন নেতারা গদি ছেড়েছেন। কিছৃু কিছু দেশে নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। স্বৈরশাসকের পতনের মধ্যদিয়ে কয়েকটি দেশে ফিরে এসেছে গণতন্ত্র।এছাড়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতে দীর্ঘ সময় মসনদে থাকা দল ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকলেও, কিন্তু এবছর তারা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। ইউরোপের জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে কট্টর ডানপন্থিরা সফলতা পেয়েছে। রোমানিয়াতেও একই চিত্র দেখা গেছে, তবে সেখানে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ ওঠায় পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ইউরোপ আবার ১৯৩০ এর দশকের মত কোনো অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কি না, যে সময়টায় ফ্যাসিবাদের জাগরণ ঘটেছিল। জর্জিয়া ও মলদোভায় রাশিয়া ঘেঁষা দলগুলো জনমত জরিপের চেয়েও ভালো করেছে। ইউরোপ ডানপন্থিদের অর্থনৈতিক উদ্বেগের দিকে ঝুঁকলেও একই উদ্বেগ কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তনকে ভিন্ন দিকে নিয়ে গেছে। যেমন- ব্রিটেনে বামপন্থি লেবার পার্টি কনজারভেটিবদের ১৪ বছরের শাসনের ইতি ঘটিয়েছে।
বছরজুড়ে উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য
উত্তপ্ত বছর পার করলো গোটা মধ্যপ্রাচ্য। ভূরাজনীতি এবং কৌশলগত দিক থেকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলটিতে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ড, ইয়েমেন, সৌদি আরব, ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যকার পারস্পরিক সংঘাত রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ অঞ্চলের সংঘাতগুলোতে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী এবং শিশু। গুরুতর আহত হয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। ধ্বংস হয়েছে ৫০০টির বেশি স্কুল ও হাসপাতাল। হাজারো বাড়িঘর, ধর্মীয় স্থাপনা, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে।
নিজ দেশের মানুষের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশে বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থীদের প্রথমে কোটা এবং পরে সরকার পতনের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত জুলাই ও অগাস্ট মাসে শিক্ষার্থীদের উপর গুলি চালানো হয়। এই গণঅভ্যুত্থানে প্রথম ধাপের খসড়া তালিকায় ৮৫৮ জন শহীদের নাম এবং আহতদের তালিকায় ১১ হাজার ৫৫১ জনের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। চরম অরাজকতা, লুঠতরাজে জেরবার ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ছোট দেশ হাইতি। মাফিয়াদের তাণ্ডবে বিপন্ন সাধারণ মানুষের জীবন। ১৫ মার্চ রাজধানী পর্তোপ্রাঁসের ৮০ শতাংশ দখল করে নেয় বিভিন্ন গ্যাং। ইস্তফা দিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়াল হেনরি। একাধিক শহরের কারাগার ভেঙে অপরাধীদের বেরও করে দেয় মাফিয়ারা। ২০২১ সালে সামরিক ক্যু'য়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলে নেয় দেশটির জান্তা বাহিনী। এরপর থেকে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জান্তা বাহিনীর সংঘর্ষ চলছে। তবে সাম্প্রতিক সময় সংঘর্ষের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। চলতি ডিসেম্বরেই দেশটির রাখাইন রাজ্যের উত্তর সীমান্ত এলাকা পুরোপুরি দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি (এএ)।
দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তানেও ২০২৪ সাল জুড়েই ছিল নানা অস্থিরতা। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খানের মুক্তি নিয়ে বছরজুড়ে আন্দোলনে হয়েছে। পিটিআই'র বিক্ষোভ দমাতে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে। ইসলামাবাদে জমায়েত ঠেকাতে জারি করেছিল ১৪৪ ধারা। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ইন্টারনেট পরিষেবাও। তবে এরপরও পিটিআই সমর্থক ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) আফগানিস্তানের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। এতে অন্তত ৪৬ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও অনেকে। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে বলে জানিয়েছে আফগানিস্তান। টিটিপি'কে লক্ষ্য করে হামলা করা হয়েছে বললেও আফগানিস্তান বলছে, বিভিন্ন গ্রামে হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। এর পাল্টা জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ার বার্তা দিয়েছে আফগানিস্তান। তাই বছর শেষ হওয়ার আগে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিলো। এছাড়া কোরিয়াতেও প্রেসিডেন্টের অভিশংসন নিয়ে ছিল অস্থিরতা।
ভারতের সঙ্গে বহি:বিশ্বের দ্বন্দ্ব অব্যাহত
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বর্তমানে খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। প্রতিদিনই নানা ইস্যুতে দেয়া বিভিন্ন বক্তব্য দু’দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনকে আরও স্পষ্ট করেছে। সারা বছরই ভারতের সঙ্গে কথা কাটাকাটি চালিয়ে গেছে বিভিন্ন দেশ। ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লাক্ষাদ্বীপ সফরের পরেই মালদ্বীপ-ভারত সংঘাত তুঙ্গে ওঠে। মোদিকে নিয়ে নানা বিতর্কিত মন্তব্য করেন দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুর দলের একাধিক নেতা। এমনকী ভারতের সমুদ্র সৈকতগুলো নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত বলেও কটাক্ষ করেন সেদেশের কয়েকজন নেতা। তারপরই নিন্দার ঝড় ওঠে। গোটা ভারত জুড়ে শুরু হয় ‘বয়কট মালদ্বীপ’। শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে ভারত ও কানাডার মধ্যে চলতি বছর সম্পর্ক চরম উত্তেজনায় রুপ নেয়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গত অক্টোবরে দাবি করেন, নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ভারত সরকার সহযোগিতা করছে না। সেইসঙ্গে কানাডার মাটিতে সহিংসতার পেছনে ভারতের এজেন্টরা জড়িত আছে বলে অভিযোগ রয়েছে- এমন দাবি করেন ট্রুডো। তবে ভারত, কানাডার সব অভিযোগ উড়িয়ে দেয়। এর ফলে দেশ দু’টির কূটনীতিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে। কানাডা ভারতের ছয়জন কূটনীতিবিদকে বহিষ্কার করে। এর জবাবে ভারতও কানাডার কূটনীতিবিদদের বহিষ্কার করেছে। ২০২৪ সাল প্রায় শেষ হতে চলেছে কিন্তু দুই দেশের সম্পর্ক এখনো তলানিতেই রয়েছে। ভারতের ধনকুবের আদানি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন দেশ। এতে ভারতের অর্থনীতি কিছুটা হলেও ধাক্কা খাবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন জীবন
১ জানুয়ারি, ২০২৪। বিভিন্ন দেশ যখন বর্ষবরণের আনন্দে মেতে ওঠে সেসময়ই প্রকৃতির রুদ্ররোষে পড়ে জাপান। বছরের প্রথম দিনেই ৭.৬ মাত্রার তীব্র ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে উদীয়মান সূর্যের দেশ। আঘাত হানে সুনামিও। প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ, ক্ষয়ক্ষতিও হয় বিস্তর। ৩ এপ্রিল ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তাইওয়ান। রিখটার স্কেলে তীব্রতা ছিল ৭.৪। মৃত্যু হয় প্রায় ১০০ মানুষের, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও ব্যাপক। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে বড় বড় হোটেল। ফাটল ধরে একাধিক সড়কে। গত ২৫ বছরের মধ্যে এটাই তাইওয়ানে হওয়া সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প। ১৬ এপ্রিল প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয় মরুভূমির দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে। রাস্তা-ঘাট থেকে শুরু করে বিমানবন্দর সব পানির নিচে তলিয়ে যায়। কোমর পানির স্রোতে খেলনার মতো ভাসতে থাকে বুগাতি, ফেরারি ও মার্সিডিজ বেঞ্জের মতো দামি দামি গাড়ি। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও নিস্তার পায়নি। রানওয়ে থেকে শুরু করে বিমানবন্দরে ঢোকার রাস্তা, গাড়ি পার্কিংয়ের এলাকা সবই পানির নিচে। ফলে থমকে গেছে বিমান ওঠানামা। থমকে গেছে পুরো শহর। ৫ মে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে ব্রাজিল। সঙ্গে দোসর প্রবল বর্ষণ। প্রকৃতির রুদ্ররোষে মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায় এবং বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হন প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ। প্লাবনে তলিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম, অন্তত ৪৯৭টি শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত ৮০ বছরের মধ্যে এটাই ছিল ব্রাজিলের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা। এতে কফিসহ বিশ্বে নানা শস্যের দাম বেড়ে যায়, যা হয়তো অব্যাহত থাকবে আগামী বছর। চলতি বছরের মে মাসে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে আফগানিস্তান। এতে নিহত হয় ৩১৫ জন। এ ছাড়া আরও এক হাজার ৬০০ মানুষ আহত হয়েছেন। স্পেনে পাঁচ দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে ২০২৪ সালের নভেম্বরে। এতে ২১১ জন মারা যায় বলে নিশ্চিত করেছে দেশটির সরকার প্রধান পেদ্রো সানচেজ।