শিরোনাম
এএফপি
প্রকাশ: ১০:১৫, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | আপডেট: ১৮:৪১, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ভারত ও পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দক্ষিণ এশিয়ার চার প্রতিবেশী দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের গতিপথ প্রায় একই ছিল দীর্ঘসময়। যা গেল বছর থেকে দ্রুত বদলে যাচ্ছে। একদিকে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা চালাচ্ছে ভারত; অন্যদিকে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলছে পাকিস্তান।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ভারত ও পাকিস্তান নামে আলাদা দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এরপর থেকে এই দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র একাধিক যুদ্ধে জড়িয়েছে এবং তাদের মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক এখনো বিদ্যমান।
সম্প্রতি পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ভারতবিরোধী জঙ্গিদের লক্ষ্য করে ভারত গোপন অভিযান পরিচালনা করেছে বলে অভিযোগ করে ইসলামাবাদ। তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আপনার উঠোনে সাপ থাকলে তা শুধু প্রতিবেশীকেই কামড়াবে, এমন আশা করা যায় না।’
২০২১ সালে তালেবান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। পাকিস্তান দাবি করেছে, আফগানিস্তানের মাটি থেকে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো তাদের ভূখণ্ডে হামলা চালাচ্ছে। কাবুলের তালেবান সরকার এসব জঙ্গিগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিচ্ছে এবং তাদের হামলা চালাতে মুক্ত পরিবেশ করে দিচ্ছে। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে তালেবান সরকার।
তালেবানের কঠোর ইসলামিক আইন এবং ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মধ্যে কোনো মিল নেই। কিন্তু পাকিস্তান-আফগান সীমান্তের এই উত্তেজনাকেই মোদির বিজেপি সরকার তালেবান সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক হাসান আব্বাস বলেছেন, ‘ভারত দীর্ঘদিন ধরে এই পথ অনুসরণ করছে। তারা চায় না, তালেবান সরকার ভারতের জন্য হুমকিস্বরূপ কোনো গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রকে সমর্থন করুক।’
চার বছর আগে কাবুলের পতনের পর গত জানুয়ারি দুবাইয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি ও তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলভি আমির খান মুত্তাকির বৈঠক করেন। জয়সওয়াল এই বৈঠককে ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ের আলোচনা’ বলে বর্ণনা করেন এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রতিশ্রুতি দেন। মৌলভি মুত্তাকিও দুই দেশের সম্পর্ক সম্প্রসারণে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, আফগানিস্তানের ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক পররাষ্ট্রনীতির আওতায় ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে চায়।
এই বৈঠকে আফগানিস্তানের জন্য ইরানের চাবাহার বন্দর ব্যবহারের বিষয়েও আলোচনা হয়। ভারত চাবাহার বন্দর উন্নয়নে ৩৭০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে; যা আফগানিস্তানের বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্প্রসারণে ব্যাপক সহায়তা করবে। এ ছাড়া চাবাহার বন্দর পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরের পশ্চিমে অবস্থিত, যা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বন্দরটি চালু হলে ভারত ও আফগানিস্তানকে পণ্য পরিবহনে শত্রুভাবাপন্ন প্রতিবেশী পাকিস্তানের বন্দর ব্যবহার করতে হবে না। ভারত দীর্ঘদিন ধরে চীনের ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক প্রভাব নিয়ে সতর্ক রয়েছে। সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সমস্যা কিছুটা শিথিল হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা অব্যাহত রয়েছে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি সম্পাদকীয়তে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক সম্পর্ককে ‘নীরব কিন্তু সচেতন সম্পর্ক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে; যা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক কৌশলগত জোট বদলে বড় ভূমিকা রাখছে।
অন্যদিকে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করে। এরপর বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতের খুব কাছাকাছি চলে আসে বাংলাদেশ। তবে ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পতন হলে তিনি ভারতে চলে যান। এরপর থেকেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক শীতল হতে থাকে; যা খুব স্বাভাবিকভাবে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠনের সুযোগ তৈরি করেছে।
গত বছরের নভেম্বরে প্রায় এক দশক পর প্রথমবারের মতো পাকিস্তান থেকে সরাসরি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে একটি কার্গো জাহাজ পণ্য খালাস করে। ডিসেম্বরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শক্তিশালী করার বিষয়ে একমত হন। এরপর বাংলাদেশের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা পাকিস্তান সফর করেন এবং দুই দেশের সামরিক সহযোগিতা নিয়ে তাঁদের আলোচনা হয়।
ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই নতুন আঞ্চলিক কৌশলে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে চাইছে। ভারত তালেবানের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়িয়ে পাকিস্তানকে চাপে রাখতে চাচ্ছে, আর পাকিস্তান বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে ভারতের বিরুদ্ধে কৌশল সাজাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি এখন এক নতুন মোড়ে দাঁড়িয়ে; যেখানে পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রভাব নতুন সম্পর্কের বিন্যাস নির্ধারণ করছে।